কণ্ঠশিল্পী নবীউল হক বাবলুর জন্ম পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায়। তবে শিশু বয়সে (১৯৬৫ সালে) বাসাবো নিজেদের বাড়িতে চলে আসেন । স্কুলের শুরু আর সঙ্গীতের প্রাথমিক হাতেখড়ি বাসাবো থেকেই। অল্পবয়স থেকেই বাবলু একদিকে সঙ্গীত অন্যদিকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের পর বাবলুর জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। এসময় লালমাটিয়া বয়েজ হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন, একই সময় যুক্ত হন কলকণ্ঠ খেলাঘর এর সঙ্গে। খেলাঘরের সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে বাবলু ও আজকের বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক প্রমুখ পর পর দুই বছর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কবির সামনে বসে কবি ভবনে গান করেন। সেই স্মৃতি তার মনে এখনো উজ্জল হয়ে আছে। বাবলুর মা কলকাতার লেডি ব্রাভন কলেজের এক সময়ের ছাত্রী আইনিন নাহার খাতুন বই পরতে এবং সঙ্গীত শুনতে খুব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাবলুর অন্য ভাইরা এবং দুই বোনও বাবলুর গান শুনতে পছন্দ করতেন। মেজভাই মাশরুকুল হক তো বাবলুর জন্য হারমোনিয়াম কিনে এনে অবাক করে দিলেন।অন্যদিকে মায়ের প্রশ্রয়তো ছিলই। ভর্তি হলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছাত্র হিসেবে ছায়ানটে। সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে পেলেন বাংলাদেশের তিনজন শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র সংগঠক ও শিল্পীকে। শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক শিক্ষা দিলেন মূলত শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ সুরে সঙ্গীত শিক্ষার তালিম দিলেন জাহেদুর রহিম ও সানজিদা খাতুনের মতো বিশিষ্ট শিল্পী। শিল্পী জাহেদুর রহিমের অকাল প্রয়াণে বাবলু সঙ্গীত শিক্ষায় উদাসীন হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আর ছায়ানটের ডিগ্রী নেয়া হয় না। সদ্য তরুণ মনে তখন শিল্পের অন্য শাখা আলোকচিত্র সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। শুরু হয় শৌখিন ছবি তোলা, ক্যামেরা সংগ্রহ আর এই খোঁজ খবর। তখন সে সেন্ট্রাল রোডের আইডিয়াল কলেজের ছাত্র। আর ফটোগ্রাফি শিখার হাতেখড়ি হয় সিনেমাটোগ্রাফি ও ফটোগ্রাফির শিল্পী বে্বী ইসলামের কাছে। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটির ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন, এবং ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ফটোগ্রাফি কোর্স এ বাবলু দুইবার BEST PHOTOGRAPHER OF THE MONTH নির্বাচিত হন। ফ্রিলান্স আলোকচিত্রি হিসাবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকেন। বাবলুর অনেক আলোকচিত্র তখন বাসস কিনে নিয়ে সংবাদপত্রে ব্যাবহার করত। কানাডা ভিত্তিক এন জি ও CUSO’র পক্ষ থেকে ছবী তুলে একাধিকবার স্লাইড শো করেন বাবলু। তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সঙ্গীত, আলোকচিত্র আর নানা দিকে চঞ্চল মন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া লেখায় ছেদ ঘটায়, চলে যান সৌদি আরবে। সময় ১৯৮৩ সাল। আবার ১৯৮৫-র অক্টোবরে ফিরে এসে ওই বছরই বেড়াতে চলে আসেন লন্ডন হয়ে কানাডার মনট্রিয়লে ১৯৮৫-র শেষে। মনট্রিয়ল সফর বাবলুর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শুরু হয় এমন এক অধ্যায় তার ছেদ আর পড়ল না। নাবীউল হক বাবলুর বর্তমানের টরন্টো প্রবাসী জীবনের সূচনা ওই মনট্রিয়লে। তখন মনট্রিয়ল প্রবাসী বাঙালিরা বিজয় দিবশ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বন্ধুরা বাবলুর সঙ্গীত শিক্ষা ও শিল্পী পরিচয় আগে থেকেই জানত। তাদের অনুরোধে বাবলু বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গাইলেন মুক্তিযুদ্ধের গান। মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান তরুণ বাবলুর কণ্ঠে দেশের গান জাগরণী গান তখন অন্য রকম মাত্রা পেয়ে যায়, বিশেষ করে প্রবাসীদের হৃদয়ে বাবলুর জোড়াল কণ্ঠ আর আবেগ ভালোবাসায় মুক্তিযুদ্ধের জাগরণী গান প্রবল আন্দোলিত করল। এর পর শুধু বন্ধুরা নয় বিজয় দিবসের উদ্যোক্তা বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশনের সবাই বাবলুকে জোর করে ধরল-তোমাকে দেশে ফিরে গেলে চলবে না, এখানেই থাকতে হবে, আমরা প্রবাসীরা তোমার গানে স্বদেশ প্রেমে উজ্জিবীত হতে চাই। তরুণ বাবলুর পক্ষে উত্তর আমেরিকায় থাকার এমন উদার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা সহজ হলো না। উদ্যোক্তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বাবলুকে কানাডায় স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ঘটনাক্রমে তখন কেন্দ্রীও সরকার সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে আশ্রয়প্রার্থী সকল আবেদনকারীকে কানাডায় স্থায়ী বসবাস করার সুযোগ করে দেয়। শুধু দেশের গান আর রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, পল্লীগীতি, বাউল, ফকিরী গান গেয়েও শ্রোতাদের মন জয় করে ফেললেন। বিশেষ করে ফকির আলমগীরের গাওয়া গানগুলোয় বাবলুর জনপ্রিয়তা ফকীরের থেকে কম ছিল না। তখন অনেকেই নাবীউল হক বাবলুকে ডাকত ছোট ফকির বলে। ১৯৮৬-র প্রথম ভাগে সাধারণ ক্ষমা, ১৯৮৭-র প্রথম দিকে কানাডার সবচেয়ে বড় শহর, বাণিজ্যিক শহর টরন্টোতে চলে আসা। এরপর গান আর নির্দিষ্ট চাকরির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন তিনি। ২০১২ সালে প্রকাশ হয়েছে নবীউল হক বাবলুর দুটি গানের সিডি-একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত-এর ‘কে এসে যায় ফিরে ফিরে’ অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়ে ‘রণাঙ্গনে মুক্তির গান’। নবীউল হক বাবলু বৃহত্তর টরন্টোর বিভিন্ন মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধের গান সহ বিভিন্ন ধরনের গানের জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে প্রবাসী শ্রোতাদের আনন্দ দিয়ে আসছেন।