Deshe Bideshe

DESHEBIDESHE

ইউনিজয়
ফনেটিক
English
টরন্টো, বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩ , ১৬ চৈত্র ১৪২৯

গড় রেটিং: 3.0/5 (51 টি ভোট গৃহিত হয়েছে)

আপডেট : ০৯-০৩-২০২০

সাহিত্য ও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি

ড. মাহফুজ পারভেজ


সাহিত্য ও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি

বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য ও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি, সদ্য-প্রয়াত রাহাত খান (১৮ ডিসেম্বর ১৯৪০-২৮ আগস্ট ২০২০)। কিছুদিন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিয়োজিত থাকলেও একজন বহুমাত্রিক লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি ও সাফল্য লাভ করেন। 

রাহাত খান একদা বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক ইত্তেফাকের গৌরবময় কালে ছিলেন সহকারী সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক। যদিও গোড়া থেকেই ইত্তেফাকের প্রতিটি বিভাগ ছিল নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের অধীন। নিউজ বিভাগকে হস্তক্ষেপ করতে পারতো না কেউই। এডিটোরিয়াল সেকশনও ছিল চাপমুক্ত। মালিকপক্ষ কিছু লিখতে চাইলে নিজে থেকেই লিখতেন, কাউকে বাধ্য করে বা চাপ দিয়ে কিছুই করার পরিবেশ সাংবাদিক, কর্মচারী ও প্রেস ইউনিয়নের দাপটের মুখে ইত্তেফাকে সম্ভব ছিল না। চাপমুক্ত, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার যে ঐতিহ্য ইত্তেফাক বিনির্মাণ করেছিল, তা অনন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ এখনো উল্লেখযোগ্য।

ইত্তেফাকের স্বাধীন-নিরপেক্ষতা ও স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার পেছনে এডিটোরিয়ালের আখতার-উল আলম, রাহাত খান, আবেদ খান, হাবিবুর রহমান মিলন, মহাদেব সাহা, ফিচারের রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই, সাহিত্য বিভাগের আল মুজাহিদী, নিউজের গোলাম সারোয়ার, হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ইউনিয়নের বর্ষীয়ান ফজলে ইমাম আর ইউনিট চিফ আলমগীর হোসেন, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের অনলাইন-মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার জনক রূপে পরিচিত হয়েছেন।

আরও পড়ুন- কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান আর নেই

এডিটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপে স্বল্পকালের কর্মজীবনে ইত্তেফাকের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আমার চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে। যে সময় আরেক এডিটোরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক ও বর্তমানে সময় টিভির নিয়াজ মোরশেদ।

রাহাত খান পরে ইত্তেফাকের সম্পাদক হন। কিন্তু সেটা ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতিতে। আরো পরে দৈনিক বর্তমান, বাসস ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বৃত্ত হন তিনি। যদিও ইত্তেফাকের রাহাত খানই ব্যক্তিত্বে ও পরিচিতে সাধারণের মধ্যে ঋদ্ধতর৷

ইত্তেফাকের সাপ্তাহিক কলামে রাহাত খান বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন। সে আমলে আজকের মতো ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে নিমেষেই তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার উপায় ছিল না। নিজের পঠন, পাঠন, অভিজ্ঞতাই ছিল ভরসা। আর ছিল ইত্তেফাকের রেফারেন্স এডিটর নোমানুল হকের তথ্যভাণ্ডার। তা দিয়ে তিনি স্মরণীয় কলামের মাধ্যমে বিপুল পাঠককে আলোকিত করেছেন।

ইত্তেফাকে সাংবাদিকতার সুদীর্ঘ বর্ণিল জীবনে রাহাত খানের অন্যতম কৃতিত্ব হলো ইত্তেফাক ভবন থেকে 'সাপ্তাহিক রোববার' নামে নান্দনিক ম্যাগাজিনের সূচনা। বিচিত্রা ও সন্ধানী যখন একচেটিয়া দাপটে বাজার দখল করেছিল, তখন রোববার চ্যালেঞ্জিং আবির্ভাবের মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয়। তরুণ ও প্রতিভাবান মেধার সমন্বয়ে রোববার পরিণত হয় দেশের অন্যতম সেরা ম্যাগাজিনে।

রাহাত খান রোববারের প্রাথমিক দিনগুলোর মূল কাণ্ডারি ছিলেন। রোববার-এর পরিকল্পনা, লোকবল নিয়োগ থেকে প্রতিটি কাজই তার দ্বারা সূচিত হয়েছিল। দেশের প্রায়-সকল লেখকদের সমবেত করেছিলেন তিনি। নিজেও লিখেছেন অকাতরে। তার লেখক জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোও সেই সময়কালে এবং তার আগে-পরে রচিত।

রাহাত খানের কথাসাহিত্যে আধুনিক জীবনবোধ ও ব্যক্তিস্বতন্ত্রের প্রকাশ সুস্পষ্ট। নিজেও ছিলেন আধুনিক রুচি ও জীবনাদর্শের অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে আধুনিক-অগ্রসর চিন্তার মেলবন্ধনে রাহাত খান তার সমকালের অগ্রণী ব্যক্তিত্বরূপে স্বীকৃত ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহের সুমৃত্তিকা থেকে জন্ম নিয়ে রাজধানী ঢাকা শহরে বসবাস করলেও তিনি ছিলেন চিন্তায় ও জীবনচর্যায় আন্তর্জাতিক চেতনার অনুসারী। একজন সমৃদ্ধ, স্বনির্মিত, সুশিক্ষিত মানুষের প্রোজ্জ্বল প্রতিবিম্ব ছিলেন তিনি।

বহু বিকেল, সন্ধ্যা ইত্তেফাকের দোতলায় তার ঘরে কাটিয়েছি তারই নিবিড় সংস্পর্শে। নিউজপ্রিন্ট প্যাডে এক বিশেষ হস্তাক্ষরে তিনি সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় রচনার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন। ঢাকার সেসময়ের তরুণ লেখক-লেখিকাদের প্রায়-সকলেই ছিল তার ভক্ত-অনুরাগী। বহুজনের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার পেছনের তার অবদান ও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে রাহাত খানের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমাদের তারুণ্য-যৌবনে সাহিত্যবোধ ও মননের বিকাশে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইত্তেফাকে আমার যোগদানেও তার অবদান আছে। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি রূপে প্রথমে ইত্তেফাক ভবনের ইংরেজি দৈনিক নিউনেশন-এ যুক্ত হই। তারপর কাজ করি সাপ্তাহিক রোববার-এ। ততদিনে আমার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হলে আমি ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সুযোগ পাই সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির সহকারী রূপে। কিন্তু বিপরীরমুখী দুই মালিকের ইত্তেফাকে উভয়ের সম্মতি ছাড়া কারো যোগদান সম্ভব ছিলনা। সেই কঠিন কাজ সহজ হয়েছিল আমার আবেদনে রাহাত খান, আখতার-উল আলম ও রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের সুপারিশ থাকায়।

বর্ষীয়ান সাংবাদিক-সম্পাদক, রাষ্টদূত আখতার-উল আলম ও বাংলাদেশের শিশু সাহিত্য ও শিশু সংগঠনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই আগেই প্রয়াত হয়েছেন। রাহাত খানও অবশেষে বর্ণাঢ্য জীবনের সীমারেখা পেরিয়ে চলে গেলেন চিরপ্রস্থানের পথে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন আশি ও নব্বই দশকে প্রবহমান স্বর্ণালী স্মৃতিপুঞ্জের নস্টালজিক ক্যানভাস।

এমএ/ ০৩ সেপ্টেম্বর

শ্রদ্ধাঞ্জলি

আরও লেখা

Bangla Newspaper, Bengali News Paper, Bangla News, Bangladesh News, Latest News of Bangladesh, All Bangla News, Bangladesh News 24, Bangladesh Online Newspaper
উপরে