চট্টগ্রাম, ০৫ জুন- করোনার মধ্যে কিছুদিন নতুন রূপে ফিরেছিল দেশের অন্যতম প্রধান নদী কর্ণফুলী। কলকারখানার দূষণ বন্ধ ছিল। কমে এসেছিল মানববর্জ্যের পরিমাণও। কিন্তু এখন ফের কাঁদছে সেই কর্ণফুলী। ফিরে আসছে সেই পুরোনো রূপ। কলকারখানার চাকা ঘুরতেই বর্জ্য মিশছে নদীতে। পড়ছে পলিথিনসহ নানা রকম বর্জ্যও। অথচ কর্ণফুলীকে রক্ষায় প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত করা হয়েছিল একটি মহাপরিকল্পনা। 'ক্র্যাশ প্রোগ্রাম', 'স্বল্প মেয়াদি', 'মধ্য মেয়াদি' এবং 'দীর্ঘ মেয়াদি' অ্যাকশন রেখে সাজানো হয়েছিল ১০ বছরের এ মহাপরিকল্পনা। এতে ৪৫টি মূল কার্যক্রম এবং ১৬৭টি সহযোগী কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছিল। অবৈধ দখলে থাকা ভূমি কীভাবে উদ্ধার করা হবে, উদ্ধারকৃত ভূমি কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এটিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পর্যটন সুবিধা বাড়ানো যাবে, নগরের বর্জ্য কোথায় কীভাবে বিকল্প স্থানে সংরক্ষণ করা হবে- এসব বিষয়েও ছিল দিকনির্দেশনা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৈরি হওয়া এ মহাপরিকল্পনাও পড়ে আছে হিমাগারে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে উল্টো নতুন করে দখল হচ্ছে চট্টগ্রামের প্রধান এই নদী।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, 'মহাপরিকল্পনা ধরে পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনার কথা ছিল কর্ণফুলী নদীকে। এ জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত আমরা। কিন্তু মহাপরিকল্পনা ধরে এখনও কাজ শুরু করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটির সর্বশেষ অবস্থা তারাই ভালো বলতে পারবে।' বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, "চূড়ান্ত হওয়া মহাপরিকল্পনা ধরে শিগগির শুরু হবে আমাদের অ্যাকশন। 'ক্র্যাশ প্রোগ্রাম', 'স্বল্প মেয়াদি', 'মধ্য মেয়াদী' ও 'দীর্ঘ মেয়াদি' অ্যাকশন রেখে ১০ বছরের এ মহাপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। করোনার কারণে সবকিছু থমকে যাওয়ায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।"
চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে ২০১০ সালের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের রিটের প্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জরিপ করে নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা আছে বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। জরিপ প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ জুন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টে দাখিল করে জেলা প্রশাসন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ সব স্থাপনা উচ্ছেদে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু তিন মাসের স্থলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল তিন বছর পর; চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু মাত্র ১০ একর ভূমি উদ্ধার করেই উচ্ছেদ অভিযানে ইতি টেনেছে এ অভিযানে থাকা চার সংস্থা। এর পর কর্ণফুলী রক্ষায় নতুন করে চূড়ান্ত করা হয় এ মহাপরিকল্পনা। এটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
আদালতের নির্দেশে আগে শুধু উচ্ছেদ অভিযানের কথা থাকলেও এবারকার মহাপরিকল্পনায় আছে কর্ণফুলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি ও দূষণমুক্ত করতে কী কী কাজ করতে হবে সেটির সার্বিক দিকনির্দেশনা। কোন প্রক্রিয়ায় উদ্ধারকৃত ভূমিকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে এতে। স্যুয়ারেজ সিস্টেম ও ওয়েস্টেজ ম্যানেজমেন্ট নিয়েও আছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।
কর্ণফুলীকে চট্টগ্রামের প্রাণ বলা হলেও সরকারি তালিকাতে এখানে অবৈধ দখলদার আছে দুই সহস্রাধিক। আবার চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ৮৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশের বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান্ট (ইটিপি) নেই। এসব শিল্প কারখানার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে মিশে পানিকে মারাত্মক দূষিত করে তুলেছে। কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী স্যুয়ারেজ বর্জ্য। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০ লাখ মানুষের স্যুয়ারেজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকা কর্ণফুলী নদীর পানি দূষণের প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম ওয়াসাকে দিয়ে তাই স্যুয়ারেজের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। সেটির কোনো সুফল এখনও পায়নি কর্ণফুলী নদী। পরিবেশ অধিদপ্তর কর্ণফুলী থেকে সংগ্রহ করা পানির নমুনা পরীক্ষা করে ডিজলভ্ড অক্সিজেনের (ডিও) মান ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৫ এর মধ্যে পায়। এটি উদ্বেগজনক। কারণ ডিও-এর মান ৪ এর নিচে নামলে তা পানিতে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ কর্ণফুলী নদীতে পতিত খালগুলোর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, খালের পানিতে ডিও-এর মান প্রায় শূন্য পর্যায়ে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মোহাম্মদ ইদ্রিছ আলম বলেন, 'চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হলে রক্ষা করতে হবে কর্ণফুলীকে। এটিকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে হলে চূড়ান্ত হওয়া মহাপরিকল্পনা ধরে শুরু করতে হবে অ্যাকশন। লোক দেখানো অভিযান নয়; কর্ণফুলী রক্ষায় দরকার কার্যকর অ্যাকশন।'
এম এন / ০৫ জুন