সবেমাত্র পড়ে শেষ করলাম তরুণ কথাসাহিত্যিক জয়দীপ দে'র নতুন ভ্রমণগ্রন্থ 'মাদ্রাজের চিঠি'। বইটা পড়ার অভিজ্ঞতা এমন; যেন বিভূতিভূষণের অপু পরীক্ষা শেষে মামাবাড়ি যাওয়ার আবদারে মায়ের আঁচল জড়িয়ে থাকা নাছোড়বান্দা শিশুর মতো জড়িয়ে আছে। লেখকের বিশ্বগ্রাসী দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলাম ভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন শহর মাদ্রাজ। ভ্রমণ কাহিনী পড়ে ভ্রমণপিপাসা নিবারণ দুরূহ কাজ। কিন্তু 'মাদ্রাজের চিঠি' পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, মাদ্রাজ ঘুরে এলেও এত তথ্য, বিশ্নেষণ, প্রাচীন-বর্তমান সামাজিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ইতিহাস জানা হবে না। লেখক নিজেও স্বীকার করেছেন, এ নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয়। লেখকের ভাষায়, 'শহরের প্রাণ ভোমরাটাকে খুঁজে ফেরার প্রয়াস।'
আসল কথা হলো, লেখক এখানে সফল। ৪২ ডিগ্রি গরমে নন এসি বাসে বসে নিজে যেমন চ্যাপা শুঁটকি হয়েছেন, তেমনি মাদ্রাজ শহরের মানুষ, তাদের জীবনাচরণ, শহরের সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা- এই সবকিছু আদি ও বর্তমান ইতিহাস ছেঁকে ঢেলে দিয়েছেন 'মাদ্রাজের চিঠি'তে। এর বাইরে আরেকটি ব্যাপার আমার মতো যে কোনো পাঠককেই আলোড়িত করবে। তা হালো, মাদ্রাজের অনেক বর্ণনা করতে গিয়েই লেখক ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের সাথে নানাভাবে তুলনামূলক বিশ্নেষণ উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন, যা এ ভ্রমণ কাহিনীকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
তবে শুধু বিভিন্ন স্থান ও অবস্থার চিত্র নয়, সেখানকার মানুষের চিন্তা, জীবনাচরণের শ্রেণিগত পার্থক্যও স্থান পেয়েছে বর্ণনায়। মাঝে মাঝে জমে থাকা ক্ষোভ আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ছুঁড়ে দিয়েছেন পরিপাটি তীর।
তথ্যপ্রযুক্তির এ উৎকর্ষের যুগে গুগলে করে আমরা আজ মুহূর্তেই পৃথিবী ঘুরে আসতে পারি। কিন্তু এই বইয়ে ছোট ছোট তথ্যের মাঝে যে ব্যাপকতা তা হয়তো গুগলে পাওয়া দুস্কর হবে। প্রাচীন মাদ্রাজ বা বর্তমানের চেন্নাই শহরের নারীরা প্রতি সকালে ঘরের সামনে চালের গুঁড়া দিয়ে আল্পনা আঁকেন, যাতে পশুপাখি সেই গুঁড়া খেয়ে বেঁচে থাকে, এবং খাবারের সন্ধানে কোনো ক্ষতিকর প্রাণী বাসায় যেন না ঢোকে। যে আলপনার স্থায়িত্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত। তবু তার মাঝে লুকিয়ে থাকে ধর্ম, জীবসেবা, শিল্প আর নিরাপত্তাও।
এ ছাড়াও মাদ্রাজ জাদুঘর, তামিলনাড়ূর জাতীয় নাট্যশালা, মেরিনা বিচ, চেন্নাই সমুদ্রবন্দর, পঞ্চপাণ্ডব মন্দির, গুইন্ডি ন্যাশনাল পার্ক, আন্না ইউনিভার্সিটি, ব্যাংগালুরুর লালবাগ উদ্যান, জগমোহন প্যালেস, মীনাক্ষী মন্দির ইত্যাদি ইতিহাস প্রসিদ্ধ জায়গার নিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। বইটিতে ভ্রমণকালীন ছোটখাটো ঘটনা, ঐতিহ্য, আদি ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, রাজনৈতিক-ধর্মীয় অবস্থা, সেই প্রাচীন মুঘল আমল থেকে শুরু করে আজকের নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাপ্তি ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের কিছু চমৎকার ছবি সংযোজন ভ্রমণ কাহিনীটির পাঠানন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে হ্যাঁ, 'আরো দেখি, সময় দিন, আরো লিখবো'- ব্যক্তিগত দিনপঞ্জি লেখার মতো কিছু বাক্য এবং ছাপার কিছু ভুল পাঠকের ছন্দপতন ঘটাতে পারে। ভ্রমণ কাহিনীর অন্যতম পুরোধা শ্রী অন্নদাশংকর রায় একটি সম্মেলনে প্রশ্ন রেখেছিলেন- 'ভ্রমণ কাহিনী কি প্রবন্ধের ঘরের পিসি, না কথাসাহিত্যের ঘরের মাসি? না একাধারে দুই-ই?' লেখক জয়দীপ দে প্রশ্নটির উত্তর সফলতার সাথে দিয়েছেন- শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি, রাজনীতির মতো কঠিন প্রাবন্ধিক বিষয়কে ভ্রমণ কাহিনীর ভেতর দিয়ে কথাসাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করে। যা সব ধরনের পাঠককেই ঋদ্ধ করতে পারে।
এমএ/ ০৪:১১/ ১৫ এপ্রিল