আমার এক বন্ধু নিউইয়র্ক থেকে ফোন করে সংবাদ দিল যে, তার একটি ছেলে হয়েছে। কংগ্রেচুলেশন জানালাম। বললো হাসপাতালে নাম রেজিষ্ট্রি করতে হবে অতএব নাম দরকার। আজই দরকার। জিজ্ঞেস করলাম- নাম আগে থেকে ঠিক করোনি? বললো, একটা ঠিক করেছি সে ব্যাপারেই আলাপ করতে চাচ্ছি। আমার স্ত্রী চাচ্ছে 'নুহাশ' রাখতে। হুমায়ূন আহমেদের ছেলের নাম। বললাম, সুন্দর নাম, রেখে দাও। সে বললো এটার অর্থ কি? বললাম, দশ মিনিট পর ফোন করো। বের করলাম আরবী-বাংলা অভিধান। পাতা উল্টিয়ে 'নুহাশ' বের করে চক্ষু স্থীর। ইতিমধ্যে তার আবার ফোন। বললাম, যে অর্থ পেয়েছি তাতে তুমি ছেলের নাম 'নুহাশ' রাখবে না। অর্থ আর জিজ্ঞেস করতে যেয়ো না। তারপরও পীড়াপীড়ি শুরু করলে বললাম, 'নুহাশ' অর্থ 'অলক্ষী'।
বলো কি? হুমায়ুন আহমেদ এই নাম রাখলেন? সে আশ্চর্য হয়ে গেলো। বললাম, বড় বড় লেখক, কবিরা এরকমই রাখেন। কলকাতার এক লেখকের কথা বললাম। স্বনামধন্য এ লেখকের ৪/৫ টি সন্তান জন্ম নেয়ার পর সর্বশেষ কন্যা সন্তানটির নাম রাখলেন 'ইতি'। ঘোষণা দিলেন 'ইতি' দিয়ে ইতি টানলাম। বছর দুই পর অ্যাকসিডেন্টালি আরেকটি পুত্র সন্তান হয়ে যায়। এবার নাম রাখলেন 'পুনশ্চ'। আমাদের দেশে একসময় সন্তানদের উপর যেন দুষ্টুগ্রহের কু-নজর না পড়ে সেজন্য অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখা হতো। এ প্রসঙ্গে আর নাই বা বললাম।
নাম নিয়ে বাঙালিরা বড্ড হীনমন্যতায় ভুগে। তবে ৭০ এর দশকে সুন্দর সুন্দর বাংলা নাম রাখা শুরু হয়। জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে ঐ সময় বিশুদ্ধ বাংলা নাম রাখার প্রচলন ঘটে। বিজয়, স্বাধীন, আকাশ, সাগর, রাত্রি, নদী, বর্ষা, শিশির, পলাশ, শিমুল, জয় ইত্যাদি ঐ সময়ের নাম। '৭৫ এর পর শুরু হলো 'আল', 'বিন', 'ইবনে' আর 'বিনতে'র যুগ। আল ফারুক, ওমর বিন শামস, ফাতেমা বিনতে... ইত্যাদি। এখন আবার ধারা পাল্টেছে; এসেছে সুন্দর সুন্দর বাংলা নাম। অনন্যা, অনিন্দিতা, অনির্বাণ, তন্ময়, প্রার্থনা, প্রেরণা, চৈতি.. ইত্যাদি। এসব নাম দেখেই বুঝা যায় এরা একুশ শতকের প্রজন্ম।
বাঙালি হিন্দুরা পৌরাণিক যুগেই ভাল ছিলেন। একক নাম ছিল। অর্থাৎ নামের আগে পিছে কিছু ছিল না। (রাম, লক্ষণ, সীতা, কর্ণ, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন ইত্যাদি) কলিযুগে এসে নামের বাহার দিতে গিয়ে এখন সামলানো কষ্টকর হয়ে গেছে। শ্রী মহেশ কুমার ভট্টাচার্য্য। ১ বছর বয়সেও কুমার, ৮০ বছর বয়সেও। নিজের শ্রী যাই থাক নামের আগে 'শ্রী' লিখে দিতে দ্বিধা করেন না। শ্রীমতি নীলিমা রানী দাস, কোন দেশের রানী বুঝানোর দরকার নেই। এক বাড়িতে কয়েক গন্ডা রানীর বাস।
বাঙালি খৃষ্টানরাতো পশ্চিমা নাম না রাখলে খৃষ্টান বলে ভাবতেই পারেন না। ইংরেজ ইংরেজ গন্ধ থাকতে হবে। বাঙালি বৌদ্ধরাও আজ পর্যন্ত বৃত্ত ভাঙতে পারেননি। যাই হোক আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের কথায়ই ফিরে যাই।
অনেকের ধারণা, আরবী নাম না রাখলে মুসলমান বলে দাবী করা যাবে না। কেয়ামতের দিনও অসুবিধা হতে পারে। এই চিন্তা মাথায় রেখে তারা নামের আগে মোহাম্মদ লেখেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন মুসলমান বলতে সকলেই মোহাম্মদ। 'মোহাম্মদ' যে একটি একক নাম তা অনেকেরই জানা নেই। অর্থবহ হোক বা না হোক, বাঙালি মুসলমানের আরবী নাম চাই (আমাদের কাছে যেটা ইসলামী বলে পরিচিত)। একটা কথা আমরা ভুলে গেছি যে, ইসলাম আসার আগেও আবদুল্লাহ, ঈসা, মুসা, ইব্রাহীম, জুলেখা, জয়নব ইত্যাদি নামগুলো ছিল। হলিউডের বিখ্যাত চিত্রতারকা ওমর শরীফের নাম কমবেশী সবাই জানেন। তিনি ছিলেন একজন কট্টর মিশরীয় খৃষ্টান। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী তারিক আজিজ ছিলেন একজন আরবী খৃষ্টান। ফিলিস্তিনের নেত্রী হান্নান আশরাভিও ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি খৃষ্টান।
সারজাহতে এক সিরিয়ান লোকের সাথে আমার দশ বছর ধরে পরিচয়। তার নাম 'মিলাদ'। একবার আমার বস তাকে একটি ক্রিসমাস কার্ড উপহার দিল। আর তখনই জানতে পারলাম 'মিলাদ' একজন খৃষ্টান। খালেদ, তারেক, ইব্রাহীম, দাউদ, নাসের এগুলো ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে সকল আরবীরাই রাখে। কে যে মুসলমান, আর কে যে খৃষ্টান বা ইহুদী বুঝা মুশকিল। এগুলো সেমেটিক জাতির নাম। স্থান ভেদে আবার অনেক নামের বানান, উচ্চারণের পরিবর্তন হয়ে অন্যরকম হয়ে গেছে। আমাদের কাছে যিনি ইব্রাহিম, ইংরেজদের কাছে তিনি আব্রাহাম; একইভাবে ইসহাক হয়েছেন আইজ্যাক, দাউদ হয়েছেন ডেভিড, জিব্রাইল হয়েছেন গাব্রেইল ইত্যাদি।
নামের ব্যাপারে আরবীরা ধর্মকে না টেনে তার গোত্র বা তার সংস্কৃতিকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। হাদিস আছে নবী(সঃ) বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের সন্তানদের সুন্দর এবং অর্থবহ নাম রাখবে' (তিনি বলেননি আরবী নাম রাখতে)। অথচ সুন্দর দূরের কথা আমাদের দেশে এমন সব নাম আছে যেগুলো অত্যন্ত হাস্যকর এবং অর্থহীন। যেমন, আবু হোরায়রা। এ নামের অর্থ বিড়ালের বাপ। আমাদের নবী (সঃ) এর এক প্রিয় সাহাবী ছিলেন। তাঁর আসল নাম আবদুর রহমান ইবনে সাখর। তাঁর চোখ ছিল বাদামী; তাই নবী (সঃ) তাঁকে মজা করে এই নামে ডাকতেন। সমগ্র আরব ভূখন্ডে এ নামে কোন মানুষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে আছে হাজারে হাজার। তেমনি আরেকটি নাম আবু বক্কর। তাঁর আসল নাম আবদুল্লাহ। এ ধরণের নাম আরব দেশে মোটেই প্রচলিত নয় (ঐ সময়ের একটা সংস্কৃতি ছিল বিভিন্ন ব্যক্তিকে আদর করে ভিন্ন নামে ডাকার; আমাদের দেশেও ছিল এবং এখনও আছে)। বাংলাদেশে আজব ধারা। হানিফা বলে কোন সন্তান নেই অথচ নাম আবু হানিফা। বিয়েই করেনি অথচ মুসার বাপ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আবু মুসা। আবু ওসমান, আবু রুশদ ধরনের প্রচুর নাম প্রায়ই দেখা যায়। ছইয়ারা (গাড়ি), ছফিনা (জাহাজ) এ ধরনের নাম কেবল বাংলাদেশেই রাখা হয়।
মাঝে মধ্যে কিছু নাম দেখে স্তম্বিত হয়ে যাই। কোন অভিভাবক তার সন্তানের নাম 'গেলেমান' রাখবে ভাবতেই পারি না। গেলেমান অর্থ সমকামী। ঢাকার এক সরকারী কর্মকর্তার নাম দেখলাম ফানা ফিল্লাহ। এর কোন সরাসরি অর্থ নেই। ধ্যানের সর্বোচ্চ স্তরকে আরবীতে বলা হয় ফানা ফিল্লাহ।
নামের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক আমি খুঁজে পাইনি। ইরানীরা ফার্সী ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের নামকরণ করে। যেমন, আজাদ, ফরহাদ, ফারাহ, ফরিদা, আফসান ইত্যাদি। তুরস্কের লোকেরা বিশুদ্ধ তুর্কি নামই রাখে। যেমন, কামাল, আদিল, মোস্তফা, ইসকান্দার, আজদা, লায়লা, রুয়া ইত্যাদি। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ঘরের কাছে ইন্দোনেশিয়ার নামগুলো দেখলেই বুঝা যায় যে, নামের ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য মুসলমান মধ্যে যে কোন হীনমন্যতা নেই। সুহার্তো, সুকর্ণ এগুলো বিশুদ্ধ সংস্কৃত নাম। সুকর্ণের মেয়ের নাম মেঘাবতী।
নামের বিকৃতিতে আমরা ইতিহাস তৈরি করেছি। খালেদা খানম। অর্থ দাঁড়ালো খালেদা স্ত্রীলোক। 'খালেদা' নিজেই স্ত্রী লিঙ্গ। খানম এখানে লাগাবার দরকার নেই। ফার্সী ভাষায় মহিলাদেরকে খানম বা খাতুন বলা হয়ে থাকে। বেগম শব্দটিও স্ত্রীদের বেলায় প্রযোজ্য। করাচী বা দিল্লীতে গিয়ে কোন মহিলাকে বেগম বললে গণপিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিজের স্ত্রীকে উর্দূভাষীরা বেগম বলে ডাকে, বিবিও ডাকে। আমরা সেটাও নামের আগে পিছে লাগিয়ে দিই। অর্থাৎ যাকে তাকে বিবি বা বেগম বলতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় না। ইউরোপ আমেরিকায় অনেকে বাপ-দাদার দেয়া নামের খৎনা করিয়ে তবেই শান্তি লাভ করেছেন। মোহাম্মদ আবুল কালাম হয়েছেন ম্যাক, জোৎস্না হয়েছেন জেসি, এবাদউল্লাহ হয়েছেন অ্যাবি, আনোয়ারা হয়েছেন অ্যানি ইত্যাদি।
আরব দেশে বা ইউরোপে নাম থাকে একটি। নামের সাথে পিতার নাম এবং পারিবারিক উপাধি বা দাদার নাম সংযুক্ত করা হয়। এটাই ষ্ট্যান্ডার্ড। আমাদের এক একটি নাম এক নিঃশ্বাসে পড়া কষ্টকর! ছেলের নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ওরফে নান্টু। বাবার নাম মোহাম্মদ আহমেদ উল্লাহ সওদাগর, দাদার নাম শেখ মোহাম্মদ ধনাই মিয়া। অর্থাৎ পুরোটা লাগালে কাগজের দুই মাথায় ধরবে কি না সন্দেহ! বিদেশে গেলে এসব নামের অধিকারিরা নানান সমস্যায় পড়েন। গত কয়েক দশক ধরে নাম নিয়ে বিদেশে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অনেক বাংলাদেশী। মোহাম্মদ আর মোসাম্মৎ নিয়ে কোনদিন ঝামেলা হতে পারে কেউ কি কখনও চিন্তা করেছেন! কিন্তু ঝামেলা হয়েছে। আসল নাম হারিয়ে এগুলোই হয়ে গেছে এখন অনেকের ফাষ্ট নেম। অনেকে মোহাম্মদকে সংক্ষেপ করতে গিয়ে 'এমডি' লেখেন। এই 'এমডি' নিয়েও ইমিগ্রেশনের মোকাবেলা করতে হয়েছে বহু লোককে। বুঝাতে হয়েছে এটা মেডিকেল ডক্টর নয়; নামেরও কোন অংশ নয়, কেবলই একটি রীতি।
আমার পরিবারের নতুন কোন অতিথির আগমণ ঘটলে অনেকে নামকরণ বিষয়টি নিয়ে আমার দ্বারস্থ হন। আমি বরাবরই বাংলা নামের পক্ষে। কারো পছন্দ হয়; কারো হয় না। সেদিন আমার পরিচিত একজন জানালেন তার পরিবারে এক কন্য সন্তান আসছে। তবে নাম নিয়ে তাদের (স্বামী-স্ত্রী) মধ্যে ট্যাগ অব ওয়ার চলছে। তিনি চান একটি আধুনিক ইংরেজি নাম আর তার স্ত্রী চান বিশুদ্ধ একটি বাংলা নাম। আমাকে বললেন এমন একটা নাম যদি দিতে পারি যেটাতে খৃষ্টান বুঝা যাবে না আবার আধুনিকও হবে। কোনো ভাবনা-চিন্তা না করেই বললাম- রেখে দেন 'অ্যালেক্সা'। জিজ্ঞেস করলেন এর অর্থ কি? আমি বললাম এর কোন অর্থ নেই এটা একটা টেকি শব্দ। খৃষ্টানও না, ইহুদিও না। তার পছন্দ হয়েছে কি না আর জানি না। তবে চিন্তা করছি আমার গোষ্ঠি-জ্ঞাতির মধ্যে আগামী দিনের সন্তানাদির কি কি নাম রাখা যেতে পারে যেগুলো হবে একেবারে হাইটেক। যেমন ছেলেদের নাম রাখা হবে 'গুগল', 'ইয়াহু', 'ভাইবার', 'টুইটার' 'অ্যামাজন', 'অ্যান্ড্রয়েড', 'ইউএসবি', হ্যাসট্যাগ; মেয়েদের নাম রাখা হবে 'মজিলা', 'ইমো', 'সাফারি', 'উইকি', 'কিন্ডেল', 'বাইনারি' ইত্যাদি। অনেকে মনে করতে পারেন আমি বোধহয় মজা করছি। না, মোটেও না। আমাদের দেশে অনেক নাম আছে যাদের নিয়ে কেউ কিছু বলতে শুনিনি। যেমন বুলেট, পাইলট, প্রিন্স, কুইন, টাইগার, এমনকি হিটলার নামের মানুষও আছে। আমার কথা কেউ শূনুক বা না শুনুক, আগামী প্রজন্মের নাম টেকি অর্থাৎ প্রযুক্তি পণ্যের নামানুসারেই যে হবে এটা আমি নিশ্চিত।
সবশেষে নাম বিষয়ক একটি গল্প।
হারিছ মিয়া সৌদি আরব গমন করলেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে কোন অসুবিধা হলো না। পাসপোর্ট-ভিসা সবই ঠিক আছে। ঝামেলাটা বেধে গেলো রিয়াদ এয়ারপোর্টে। ইমিগ্রেশন অফিসার বারবার জিজ্ঞেস করছে তোমার নাম কি?
- হারিছ মিয়া।
অফিসার আবার জিজ্ঞেস করলো: তোমার নাম কি?
একই উত্তর: হারিছ মিয়া।
নবীন অফিসার জীবনে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি কোনদিন। 'হারিছ' কোন লোকের নাম হতে পারে তা তার ধারণার বাইরে। আরবীতে 'হারিছ' অর্থ দারোয়ান এবং মিয়া অর্থ এক'শ। অর্থাৎ এক'শ নম্বর দারোয়ান। সিনিয়র কয়েকজন অফিসারও জড়ো হয়েছেন।
দোভাষীর মাধ্যমে যাত্রীকে আবার প্রশ্ন করা হলো- এ নাম তোমাকে কে রেখে দিয়েছে?
হারিছ বললো- আমার বাবা।
তোমার বাবার নাম কি?
-তরিক মিয়া।
আরবীতে 'তরিক' অর্থ রাস্তা। নবীন অফিসার আরও আশ্চর্য হয়ে তার সিনিওরদের মুখের দিকে তাকালো।