আধুনিক সাহিত্যিক তাঁর আধুনিকতার দ্বারাই একদিকে পরম্পরা থেকে উচ্ছিন্ন, অন্যদিকে সামূহিক জীবন থেকে বিযুক্ত। এই পারক্যচেতনাজাত আর্তি আধুনিক সাহিত্যের কেন্দ্রে। যাঁরা নিকৃষ্ট লেখক, তাঁরা এই আর্তির দ্বারা অনাহত; সাহিত্য তাদের কাছে মনোরঞ্জনের উপায় মাত্র; যে ফর্মুলায় লিখলে পাঠকতোষণ সম্ভব হয়, সেটিই তাঁদের অভীষ্ট। যিনি সুবেদী এবং বিবেকবান, তিনি পারক্যচেতন বলেই নিয়ত সন্ধান করেন প্রকৃত সাযুজ্যের সূত্র, যে সাযুজ্য তার স্বাতন্ত্র্যকে পূর্ণস্বীকৃতি দিয়েই তাকে সমূহের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। এই অন্বেষণ কোনো লেখককে নিয়ে গেছে রাজনৈতিক বিশ্বাসে, কাউকে বা ধর্মের আশ্রয়ে, কেউ বা চেয়েছেন কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগের দ্বারা সেতুবন্ধ রচনা করতে, কেউ বা শুধু নিজের কাছে সৎ থেকে পারক্যচেতনার আর্তঅন্ধকারকে নানা দিক থেকে আলোকিত করেছেন। নির্মলেন্দু সম্ভবত পারক্যবোধকে অতিক্রম করার জন্যই রাজনৈতিক বিপ্লববাদে আশ্রয় খুঁজেছেন; আর সম্প্রতি বিপরীত পথে চলেছেন আল মাহমুদ।
যেমন বাঙালি সমাজে, তেমনি বাংলা সাহিত্যে শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্রজনের আধিপত্য দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত। এই একচেটিয়া মাতব্বরিতে প্রথম ধাক্কা দেন নজরুল ইসলাম; তার পরে বাংলা কবিতায় গ্রাম-ঐতিহ্যকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস পান জসীমউদ্দীন। রবীন্দ্রনাথের বাউল-সাধনা মুখ্যত তাঁর কিছু গানের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতায় যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার নাগরিক আভিমুখ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
দেশ বিভাগের পরও এই প্রতিন্যাসে বিশেষ বদল ঘটেনি। সেই সময়ে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক সমাবেশে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। সেখানে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য গভীর আবেদন করা সত্ত্বেও সাহিত্যিকদের মনে সে আবেদন বিশেষ সাড়া তোলেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে আজও কলকাতার সাংস্কৃতিক আধিপত্য মনে হয় অত্যন্ত প্রবল; বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের যে নবীকরণ, সেখানে সম্ভব এবং জরুরি সেটি এখনও অনেকটাই অবহেলিত।
আল মাহমুদ শুধু শক্তিমান কবি নন; এদিক থেকেও তার কাব্যসাধনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। তার উপজীব্যে, বাকপ্রতিমায় সংযুক্তিতে নাগরিকতা এবং আঞ্চলিকতার টানাপড়েন অনেক সময় জামদানি শাড়ির কথা স্মরণে আনে। তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী; কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী, যে জলসিক্ত সুখদলজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাষা পানিউড়ী পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে, সেই কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন। তার চেতনা সেই সাদা সত্যিকার পাখি, কাটা সুপারির রঙ যার দুটি চোখের কোটরে, তার। কবিতা রমণে-কম্পিতা কোনো-কুমারীর নিম্ননাভিমূল। তিনি অবশ্যই জানেন, এ জগতে কিছুই থাকে না, তাঁর প্রেমিক প্রাতিস্বিকতা বহুকাল যাবৎ কোনো ঘর না থাকার আর্তিতে আবদ্ধ; তবু তার রক্তের মধ্যে একটি সজনে গাছ, তার জ্বর মধ্যে একটি পাখি। উচ্ছিন্ন গ্রাম এবং নির্বিঘ্ন নগরের পরিজ্ঞান তাঁর স্মৃতি ও অনুকাঙ্ক্ষার দ্বারা নিষিক্ত।
পঁচাত্তর সালে আল মাহমুদের সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই আমি তার কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক। সমকালীন যে দু'জন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে, তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়। 'জিজ্ঞাসা' প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় আল মাহমুদের একগুচ্ছ কবিতা আগ্রহী হয়ে প্রকাশ করি। আমার মনে হয়েছে যে বাংলা কবিতায় তিনি নতুন সম্ভাবনা এনে দিয়েছেন। পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেননি, তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন, আঞ্চলিক ভাষা, অভিজ্ঞতা, রূপাবলিকে, তিনি নাগরিক চেতনায় সন্নিবিষ্ট করে প্রাকৃত অথচ ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এক কাব্যজগৎ গড়ে তুলেছেন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ- উভয়ের থেকেই তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে।
আল মাহমুদের কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করার পর অনেক বাংলাদেশি পাঠক আমাকে পত্র লিখে জানান যে আল মাহমুদ বর্তমানে ইসলামপন্থি প্রচারক হয়ে উঠেছেন, যে তিনি সরকারের সমর্থক ও প্রগতিবিরোধী যে সেই কারণে তাঁর প্রতি আমার মতো র্যাডিক্যাল মানবতন্ত্রীর অনুরাগ অযৌক্তিক ও অসঙ্গত। উত্তরে আমি আল মাহমুদের পাঠানো আরেকগুচ্ছ কবিতা 'জিজ্ঞাসা' তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশ করি এবং পাঠক-পাঠিকাদের জানাই যে, কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অংশভাক অথবা তার বিবিধ ক্রিয়াকলাপের সমর্থক না হয়েও তার কবিতা উপভোগ করা সম্ভব বলেই আমি মনে করি। অনুভবের সততা, কল্পনার মৌলিকতা, শব্দব্যবহারে দক্ষতা, উপমা ও ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমার উদ্ভাবনাশক্তি যাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ তার বিশ্বাস ও ব্যবহার যা-ই হোক না কেন, তার কবিতায় সাড়া দেওয়া কাব্যানুরাগীর পক্ষে স্বাভাবিক।
ঢাকায় পৌঁছানোর পর বিভিন্ন ছোটখাটো আলোচনায় আল মাহমুদ সম্পর্কে বিরূপ কথা শুনি। যাঁরা বলেন, তাঁরা অধিকাংশই তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা অধ্যাপক, কেউ কেউ কবি ও সাংবাদিক। তিনি যে একজন বড় কবি- এ কথা অবশ্য তারা অনেকেই মানেন; কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা যে ইসলামী গোঁড়ামি, পশ্চিম এশিয়ার পেট্রোডলার এবং সামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা- এই তিনে মিলে বাংলাদেশের সামূহিক ক্ষতি করতে পারে এবং কোনো শিল্পী, তিনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামরিক সরকারকে সমর্থন করেন, তখন তাকে আর শ্রদ্ধা করা চলে না। তাঁদের কথা থেকে এটুকু বুঝতে পারি যে শিক্ষিতদের মধ্যে অনেকেই আল মাহমুদের বিরোধী এবং ঢাকায় বর্তমানে সম্ভবত তিনি। নিঃসঙ্গ এবং প্রবহমান প্রধান ভাবধারা থেকে বিচ্ছিন্ন।
আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবছি, এমন সময়ে এক সকালে আল মাহমুদ আমাদের ধানমণ্ডির আস্তানায় নিজেই হাজির হলেন। বেশ কিছুক্ষণ তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হলো; পরে আরও বার দুই তার সঙ্গে বসি, একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, অন্যবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁর দপ্তরে। আল মাহমুদের কথা শুনে এবং তাঁর সাম্প্রতিক লেখা পড়ে সন্দেহ থাকে না যে তাঁর অন্তজীবনে একটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে; এ পরিবর্তন হয়তো এলিয়টের 'দি ওয়েস্টল্যান্ড'-এর পরবর্তীকালীন পরিবর্তনের চাইতে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। যে কবির কাছে মাটি ছিল জলসিক্ত সুখদলজ্জায় নিজেকে উদাম করা নারী, যাঁর কবিতায় পাওয়া যেত পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ, অভাবের অজগর যাঁর টোটেম, বালুর গতরে চুমো খেতে খেতে যাঁর মনে পড়ত পানিউড়ী পাখির ছতরে শিষ্ট ঢেউয়ের পালের ছলছল ভাঙার কিসিম, দলকলসের কোপে নিজের কাফন পরে কাত হয়ে শুয়ে যিনি দেখেছিলেন সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ, তিনি এখন অপেক্ষা করছেন সেই স্থির সুন্দর হাসি দেখবার জন্য, যা যেন 'রেহেলের ওপর বিশ্বাসীর কোরআন মেলে ধরা'। আল মাহমুদের কবিতা (১৯৮০) সংকলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন :'প্রাণের সাথে প্রকৃতির এবং দৃশ্যমান জগতের বস্তুনিচয়ের পরস্পরের তুলনা-প্রতিতুলনার সফলতা ও ব্যর্থতাই সম্ভবত কবির জীবনকে অধিকার করে থাকে। এখন আর প্রাণের সঙ্গে প্রকৃতির তুলনা আমাকে তৃপ্তি দেয় না, বরং ছেলেখেলা মনে হয়। পবিত্র কোরআন পাঠ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে আমার অতীতের সর্বপ্রকার ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধকে পাল্টে দেয়। এমনকি সৌন্দর্যচেতনা ও কবিস্বভাবকেও।'
পরিবর্তন জীবনের লক্ষণ, অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তির চাইতে পরিবর্তন সততই কাম্য। কিন্তু বিশ্বাস জিগির হয়ে দাঁড়ালে তার মুখ মস্কোর দিকেই তোক আর মক্কার দিকেই তোক, ফল কবিতার অপমৃত্যু। পাউন্ডের মতো আল মাহমুদও ইহুদিদের আক্রমণ করে ভয়ঙ্কর একটি কবিতা লিখেছেন; আঞ্চলিক শব্দরাজির মধ্যে যিনি বাংলার অফুরন্ত বহমানতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন, তিনি মাঝেমধ্যে অকারণে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশে প্রায় অপরিচিত নানা আরবি শব্দ। তিনি আমাকে একটি বই দিয়ে বলেন, তাঁর বর্তমান ভাবনাচিন্তা এটির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। বইটির নাম 'ম্যান অ্যান্ড ইসলাম'। ফার্সিতে রচিত আলি শরিয়াতির এই বক্তৃতা সংগ্রহ ইংরেজিতে তর্জমা করেছেন গুলাম ফায়েজ; এটি ইরানের মাসাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত। আলি শরিয়াতির বক্তব্য নিয়ে এখানে আলোচনা করব না, তবে আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতায় যে ধর্মবিশ্বাস উচ্চারিত, তার সঙ্গে শরিয়াতির ইসলাম ব্যাখ্যার বিশেষ সম্পর্ক আছে। আমার ধারণা, যেহেতু আল মাহমুদ হাড়ে-মজ্জায় কবি, ধর্মবিশ্বাস অথবা রাজনীতি তাকে জীর্ণ করতে পারবে না। যার রক্তের মধ্যে একটি সজনে গাছ; জ্বর মধ্যে একটি পাখি, মানবিক নির্মাণের প্রতি আস্থা হারালেও প্রতিটি রঙের মধ্যে অন্য রঙ না দেখে তার উপায় নেই। তবে আঞ্চলিক বাংলার শব্দভাণ্ডার থেকে আরবি শব্দ প্রয়োগের দিকে ইসলামী সংস্কৃতির কারণে বেশি ঝুঁকলে বিপদের আশঙ্কা আছে।
আল মাহমুদের স্বঘোষিত ধর্মবিশ্বাস বাংলাদেশের বেশ কিছু উচ্চশিক্ষিত পাঠককে তার প্রতি বিমুখ করেছে। কোনো কবির বিশ্বাসতন্ত্রকে অবশ্যই অগ্রাহ্য করা চলে না। সৌভাগ্যবশত শিক্ষা এমন একটি অনন্যতন্ত্র জগৎ রচনা করতে সক্ষম, যেখানে প্রবেশপত্র পাওয়ার জন্য শিল্পীর বিশ্বাসতন্ত্রের অংশভাক হওয়া অবম শর্ত নয়। রবীন্দ্রনাথ, এলিয়ট কিংবা আল মাহমুদ- এঁদের কারও ধর্মবিশ্বাসেই আমার নাস্তিক মানবতন্ত্রী মন আদৌ সায় দেয় না।
কিন্তু কাটুলুস, কালিদাস, লিপপা, রিলকে, এলুয়ার বা নেরুদার মতো এঁদের কবিতাও আমার চেতনায় অনুরণন তোলে। আমার সমকালে বাংলা ভাষায় যে অল্প কয়েকজন খাঁটি কবি দেখা দিয়েছেন, আল মাহমুদ তাদের ভেতরে একজন। নাস্তিক্যের নিস্তব্ধতায় তিনি প্রার্থনার ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিতে চান বটে; কিন্তু তিনি যে প্রচারক নন, তিনি যে কবি তার কারণ নারীর ক্লান্তির মধ্যে যত ভাঁজ আছে, তার খুলে যাওয়া তিনি দেখতে পান। প্রেয়সীর নাকফুল থেকে বয়ে আসা ঘামের স্রোত তার কাছে একটি নদীর জন্মের মতো সুন্দর ও রহস্যময়, শাড়ি থেকে চুইয়ে পড়া নিশিন্দা পাতার গন্ধ তার স্মৃতিকে এবং আমাদের ইন্দ্রিয়কে মাতায়, কবুতর খোলা থেকে মাকুফেরানো একটি মেয়ের আমন্ত্রণ তার বুকের ভেতরে হাপর দোলায়। আল মাহমুদ গল্প লিখেন, আত্মজীবনী লিখেন। একসময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন, সাম্প্রতিককালে তার ধর্মবিশ্বাসের কথা ঘোষণা করে থাকেন, কিন্তু পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত তিনি একজন জলজ্যান্ত কবি।
-রচনাকাল :নব্বই দশক
শিবনারায়ণ রায় [১৯২১-২০০৮]
এমএ/ ০৪:০০/ ২৪ ফেব্রুয়ারি