আহমেদ আব্বাসের লেখা ষোলটি গল্পের সংকলনে সর্বশেষে গ্রন্থিত গল্প 'আত্রাই নদীর বাঁকে বাঁকে'র নামেই সংকলনটির নামকরণ। সেই গল্পটির সর্বশেষ বাক্যনিচয় হলো-
'আজ তেতাল্লিশ বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামটির পাশ দিয়ে চলনবিলের ভেতর দিয়ে দেশের সবচাইতে প্রশস্ত এবং আধুনিক ধাঁচে নির্মিত ঢাকা-রাজশাহী হাইওয়ে। গ্রামবাসী পৌর সুবিধা ভোগ করছে। গ্রামের ভেতর ছোট-বড় প্রায় সকল রাস্তাই এখন পাকা। ঘরে ঘরে ইলেকট্রিসিটির স্বাচ্ছন্দ্য ব্যবহার। কিন্তু গ্রামের প্রথম উচ্চশিক্ষিত, ক্ষুরধার মেধাবী, সচেতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সৃজনশীল ও পরিচ্ছন্ন রুচির সেই সাহসী যুবকটি স্বাধিকারের পক্ষে কথা বলার অপরাধে রাজাকার বাহিনীর হয়রানি যাকে ঘরছাড়া করেছিল, সে আজও ঘরে ফেরেনি। সে গ্রামবাসীর সকলের প্রিয়। যার কাছে বর্ণ পরিচয় না শিখলে আজকের এই গদ্য রচনাটি আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হতো না। আমি আমার আসাদ ভাইয়ের কথা বলছি।'
'গল্প সংকলন' বলে চিহ্নিত হলেও এর শেষ রচনাটির সঙ্গে উৎসর্গটি মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় বইটি নিতান্ত অলস কল্পনার ধারক নয়। আসাদ ভাইয়ের মতো 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা' চরিত্র লেখকের স্বকপোলকল্পিত নয়। শুধু শেষ রচনাটির কথাই বা বলি কেন? বইয়ের প্রায় রচনা পাঠ করেই যে কোনো পাঠক তার সত্তায় আকাড়া বাস্তবের অকৃত্রিম প্রতিফলনের অনুভবে চকিত হয়ে উঠবেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজাকারদের প্রবল প্রতাপান্বিত অবস্থান অবলোকন করে (এমনকি, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘৃণ্য রাজাকারকেও মুক্তিযোদ্ধা সনদে ভূষিত হতে দেখে) ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। যেমন বইয়ের প্রথম রচনা 'চলনবিলের জলতরঙ্গ'-এর শেষ কথাগুলো- 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের প্রাণনাশে সহায়তাকারী এমন হিংস্র, নির্দয়, নির্মম ও মানবতার শক্র শেষোক্তজন পরবর্তীকালে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশংসাপত্র পেয়েছেন। যুদ্ধ না করেও স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকেও অনেকেই আজকাল মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়ে গেছেন। তবে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেও এমনকি জীবনবাজি রেখে শহীদ হয়েও গ্রুপিং-লবিং এবং চেষ্টা ও অজ্ঞতার অভাবে এখনও অনেকের পরিবারই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পায়নি।'
ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হওয়ার মতো অনেক সত্যই আব্বাস এখনকার পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সাবালক ছিলেন যারা, তাদের কারও কাছেই সেসব সত্যের প্রায় কোনো কিছুই অজ্ঞাত নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে যাদের জন্ম, তাদের সামনে সে সময়কার অনেক ঘটনা-পরম্পরাই তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। সেই প্রয়োজনবোধে তাড়িত হয়েই আব্বাস কলম ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সূচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, যেদিন মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক কাঠামো ঘোষিত হয়, সেদিনই নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানা সদরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা প্রবেশ করে, এবং
"পথে দেখা যায়, বহুলোক সেদিকে যাচ্ছে। ...সবার মাথায় নানা ধরনের লটবহর, মালপত্র কিংবা পণ্যদ্রব্য। সবার মুখই ভীতির ভেতরে প্রীতিপূর্ণ। নিখরচায় পণ্যদ্রব্য পেয়ে চিত্ত প্রসন্নতায় পরিতৃপ্ত হলেও তাদের প্রবৃত্তি একটু বিফল এবং বিভ্রান্ত। হাজার হোক তারা তো তাদের একান্ত আপনজনের মতোই ছিল, একসঙ্গেই প্রাত্যহিক দিনযাপন ছিল।
...কেউবা বিভিন্ন গ্রামের ধনবান লোক, কেউবা মাস্টার, কেউবা কেরানি, কেউবা কৃষক, কেউবা দিনহীন দরিদ্র, কেউবা ব্যবসায়ী। কিন্তু সবাই মুসলমান। নিমিত্ত গুরুদাসপুরে হিন্দুবাড়ি লুটতরাজ হচ্ছে। লুটের মালামাল ঘাড়ে আর মাথায় নিয়ে সবাই বাড়ির দিকে ধাবমান।
ঘটনাস্থলে তখন হানাদার পাকিস্তানি মিলিটারিরা এসে স্থানীয় কিছু মুসলমানদের জড়ো করে বলতে থাকে, 'আমরা তোমাদের জন্য। কিন্তু হিন্দুদের জন্য নয়। হিন্দুদের মাল, গণিমতের মাল। লেকিন লো বাঙালি লো, হিন্দু কা মাল লুটে লো।' এভাবে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের উস্কানি দিতে থাকে। শান্তি সম্প্রীতিতে বিভেদ সৃষ্টি করতে থাকে। হাজার বছরের ভ্রাতৃত্ববোধে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করে।"
ভ্রাতৃত্ববোধে ফাটল ধরাবার চেষ্টায় তার যে সফল হয়নি, এমন কথা বলা যাবে না। 'আত্রাই ও নন্দকুজার সন্ধিস্থলে' গল্পটিতে যে ফাটলের কথা বলা হয়েছে, দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই ফাটলকে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর করার দুস্কর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ও প্রতাপ একটুও হ্রাস পায়নি। 'রাজনৈতিক দাক্ষিণ্য' বরং এখন কল্পনার সকল সীমা অতিক্রম করে গেছে। এমন অচিন্তিতপূর্ব সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলোর মুখোমুখি হয়ে আমাদের বুক থেকে হতাশার দীর্ঘশ্বাসই উৎসারিত হয় কেবল। তবে হতাশা ছড়ানো আহমেদ আব্বাসের লেখার উদ্দেশ্য নয়। তিনি একান্তরূপেই সত্যসাধক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আব্বাস অনায়াসেই বলতে পারেন- 'ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে; এ-ও বলতে পারেন- সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।' তার প্রতিটি রচনাতেই তিনি ভালোমন্দ নির্বিশেষে কঠিন সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার পরিচিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- কঠিন শ্রমসাধ্য ও কঠোর বাধাধরা চাকরিতে থেকেও সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা এবং মানসিক পরিতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গত পনের-ষোল বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় গল্প-গদ্য লিখে যাচ্ছেন। দাপ্তরিক কাজে লেখকের পূর্বপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার মাটিতে পা রাখার সুযোগ হয়েছে।
যত বিদেশের মাটিতে পা রাখুন না কেন তিনি, স্বদেশের জল-মাটি হাওয়ার সঙ্গে তার সত্তার গভীর সম্পর্ক এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয়নি। সমাজের কাছে এ রকম দায়বদ্ধতা প্রকাশ খুব মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
মৃত্তিকালগ্ন এই মানুষটিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
এমএ/ ১১:২২/ ২৩ জানুয়ারি