ঢাকার জগন্নাথ কলেজে প্রথম পরিচয়। সম্ভবত ১৯৫৩ কি '৫৪ সালে। আমি অমিশুক মানুষ, কী করে জানি সহজেই আপন করে নিল ও আমাকে। ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে ফিসফাস করতাম আমরা। ছোটখাটো মানুষ, আমীর-উল ইসলাম নামে একটা ছেলেও বসত আমাদের সঙ্গে। বেশ জমে উঠছিল ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু অল্প কিছুদিন। তারপরেই হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল সৈয়দ হক। মনটা ছিল ওর উড়ূউড়ূ বোহেমিয়ান। দেশের বাইরে গেল, সম্ভবত বোম্বেতে, বিলেতেও ছিল বহু বছর। দীর্ঘ বিরতির পর দেশে ফিরলে মাঝে মাঝে ফোন করত অথবা হুট করে বাসায় এসে হাজির হতো।
ফোনের নমুনা এই রকম : ক্রিংক্রিং। ধরলাম।
'হ্যালো?
'আপনি কি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব বলছেন?
'বলছি। আপনি?'
'আমি হলাম দিল্লির বাদশা, শাহেনশাহ সৈয়দ শামসুল হক।'
হো-হো হাসি। আমার ডাকনাম নবাব, ওর বাদশা। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড় ছিল, কিন্তু ভাব দেখাত যেন কত বড়।
মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে, একুশের মেলায় কিংবা সেগুনবাগিচার রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে চট করে উঠে এসেছে দোতলায় আমার ঘরে। গল্প যা হতো বেশিরভাগই মামুলি। আমার বা ওর লেখালিখি নিয়ে কথা হতো না একেবারেই।
তেষট্টি সাল, তখন গান গাই। 'সুতরাং' ছায়াছবির একটা গান 'এই যে আকাশ এই যে বাতাস বউ কথা কও সুরে যেন ভেসে যায়' রেকর্ড করতে গিয়েছিলাম মতিঝিলে হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির স্টুডিওতে। ওই গানের সঞ্চারিটা গেয়েছিলেন শিল্পী আবদুল আলীম। ওখানে দেখলাম ব্যস্ত-সমস্ত ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছে বাদশা। আমাকে দেখেই কাছে এসে কাঁধে হাত রাখল। জানলাম ওই ছবির কাহিনী, সংলাপ ও গান ওরই লেখা।
সৈয়দ হকের বিদুষী স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকও একজন সুলেখক। সাইকিয়াট্রির পাশাপাশি অনেকগুলো চমৎকার বই লিখেছেন। তার একটা বইয়ের নামটা মনে নেই, উৎসর্গের কটি লাইন পড়ে চমকে গিয়েছিলাম, ছাত্রজীবনের এক বন্ধুর উদ্দেশে লেখা। শেষ কথাটি ছিল : 'মনে কি পড়ে, প্রিয়!' ...কী অদ্ভুত সুন্দর!
যাক, আবার বহুদিন দেখা নেই বাদশার। ততদিনে 'সব্যসাচী' হিসেবে ও সর্বজনস্বীকৃত। দুই হাতে লিখে চলেছে কবিতা, নাটক, উপন্যাস, চিত্রনাট্য...। 'মাসুদ রানা' লেখার জন্য যখন সুসাহিত্যিকরা আমাকে ঘিরে ধরে খামচি আর কিল-গুতো মারতে শুরু করল, সেই সময় আবার একবার দেখা হলো ওর সঙ্গে বিচিত্রার শাহাদত চৌধুরীর অফিসে। আমার পাশেই বসল ও, খুব শান্ত গলায় বলল, 'নবাব, তুমি তোমার কাজ করে যাও। খুব ভালো লিখছ। ভিন্ন ধারার সাহিত্য হলেই কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কলম কেড়ে নিতে হবে, এই নীতি আমি সমর্থন করি না। কারও তোয়াক্কা না করে তুমি লিখে যাও। একদিন দেখবে এরা নেই, কিন্তু তুমি আছো।' সেদিন এই কটা কথা আমাকে কী যে স্বস্তি ও ভরসা জুগিয়েছিল বলে বোঝাতে পারব না।
ধীরে নিচুগলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলত ও। মনে হতো মুক্তো ঝরছে।
আরেক দিন বাসায় এলো। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল, 'আমীর-উল ইসলামকে মনে আছে?'
'কোন আমীর-উল ইসলাম?'
'ব্যারিস্টার।'
'ওহ, উনি তো বিরাট মানুষ। নাম শুনেছি, কিন্তু আমার মনে থাকতে হবে কেন?'
'বাহ্! মনে নেই, কলেজে ইংরেজি ক্লাসে আমাদের সঙ্গে লাস্ট বেঞ্চে বসত!'
'সেই ছোটখাটো মানুষটা? সে-ই এখন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম? মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের একজন... সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা... ওরেব্বাপ!'
'যোগাযোগ রাখোনি, তাই কাছের মানুষও এখন তোমার অপরিচিত। এই সেদিন আমীর-উল বলছিল, কাজী আনোয়ার তো এখন মস্ত, জনপ্রিয় লেখক; ও কি আমাকে চিনতে পারবে?'
'বলে কী! যে বিশাল মানুষটাকে বাংলাদেশের সবাই চেনে, শ্রদ্ধা করে, তাকে আমি চিনব না, মানে? কিন্তু ও যে আমাদের সঙ্গে পড়ত সেটা সত্যিই একদম ভুলে গেছি।'
'কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখো না কেন?' শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল সৈয়দ হক।
কৈফিয়তের সুরে বললাম, 'অনেক বেশি কাজের বোঝা নিয়ে ফেলেছি কাঁধে। প্রতি মাসে বই লিখে সেটার প্রুফ দেখা, ছাপা, প্রকাশ করা, সেসব আবার বিক্রির ব্যবস্থা করা- সব কাজ একা করতে গিয়ে আঠালো কাদায় আটকে শ্নথ হয়ে গেছি। এমনিতেও, জানোই তো ব্রাইট মানুষ নই আমি। এসব সামলাতেই জান খারাপ হয়ে যায়, কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখা তো দূরের কথা।'
সরল স্বীকারোক্তি শুনে হাসল, বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল শাহেনশাহ, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'তোমার মতো আমিও কলম পিষে একটা বাড়ি করেছি, গুলশানে। একদিন এসো না, চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে?'
মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলাম, কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। তারপর তো বন্ধু আমার মরেই গেল। এমন শান্ত, মিষ্টভাষী, সহৃদয়, তীক্ষষ্টধী মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি আমি।
এমএ/ ০৯:৩৩/ ২১ ডিসেম্বর