হুমায়ূন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যের তুলনারহিত জনপ্রিয় এক নাম। ১৯ জুলাই বাঙালির অতুল এই কথাকারের মৃত্যুদিবস। এ উপলক্ষে তার বিপুল সৃষ্টি থেকে প্রিয় তিন গ্রন্থের পাঠ-পর্যালোচনা লিখেছেন তিন প্রজন্মের তিন লেখক...
একটিমাত্র সাল। তার মধ্যে অসামান্য গৌরব ও অন্তহীন বেদনার ইতিহাস লিখিত। রক্তে রঙিন লিপি। অহঙ্কার, শৌর্য-বীর্যে অত্যুজ্জ্বল। নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসের নাম '১৯৭১'। কলেবর অতি সংক্ষিপ্ত। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের কথা আমরা জানি। ঔপনিবেশিক, স্বৈরাচারী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ওপর। জাতিতাত্ত্বিক বিলোপ সাধনের হিংস্র পাশবিক মনোবৃত্তি নিয়ে তারা তাদের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতে প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু সক্ষম হতে পারেনি। বাঙালি মৃত্যুপণ জনযুদ্ধে জয়ী হয়। ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। সেই ক্যানভাসের বিস্তৃতি ও তাৎপর্য অনেক; নানা মাত্রিক। এর একটি অংশকে বিষয় করা হয়েছে এ উপন্যাসে।
ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামের নাম নীলগঞ্জ। একাত্তরের মে মাসে ঘটছে ঘটনা। নিস্তরঙ্গ জনজীবন এই জনপদে। পাকিস্তানি মিলিটারি হঠাৎ ঢুকে পড়ে এখানে। থানা গাড়ে স্থানীয় স্কুলঘরে। তাদের অপকর্মে হাত মেলায় এদেশীয় দোসররা। হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করে হানাদার বাহিনী তাদের স্যাডিস্ট নৃশংসতায় লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু। বীভৎস ঘটনা ঘটাতে থাকে একের পর এক। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একাত্তর সালে এমন চিত্রই স্বাভাবিক ছিল নানা জায়গায়। কুশলী কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ নিপুণভাবে সেই চিত্র এঁকেছেন তার দরদি কলমে। স্বচ্ছন্দে তিনি গল্প বলে যান। নির্বিকার, নির্মোহ সেই বয়ান। ঘটনা তার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। শ্বাসরুদ্ধকর উৎকণ্ঠা নিয়ে পাঠক এগিয়ে যেতে থাকেন। সে আকর্ষণ চুম্বকের মতো। এখানেই ঔপন্যাসিকের সার্থকতা। গৌণ কিছু খুঁত যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে তা ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া সমীচীন হবে না। ছিদ্র অন্বেষণের চাইতে এ উপন্যাসের বিষয়, মর্ম, শিল্পবুনট, সাহসী ও বিশ্বস্ত চিত্রায়নের ব্যাপারটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি।
বন্দি, অসহায় মানুষদের মনের ভেতরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ঘৃণা এক সময় ফুটে বেরোয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা সেই ঘৃণার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। পাকিস্তানি মেজর এজাজের সহযোগী বাঙালির নাম রফিক। প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার আজিজুর রহমান মল্লিককে ধরে আনা হয়। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। মসজিদের ইমামকে ধরে এনেও নির্যাতন চালানো হয়। আজিজ মাস্টারকে নিয়ে পৈশাচিক হাসি-তামাশা করে পাকিস্তানি মেজর। কেমন সে নৃশংসতার নমুনা? নগ্ন করে ফেলা হয় তাকে। নির্দেশ দেওয়া হয়- তার পুরুষাঙ্গে ইটের টুকরো ঝুলিয়ে সমস্ত গ্রাম ঘোরাতে। পাকিস্তানি মেজরের বাঙালি সহচর রফিক বিপজ্জনক জেনেও এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করে।
..."রফিক থেমে থেমে বলল- মানুষকে এভাবে লজ্জা দেবার কোন অর্থ হয় না।
মেজর সাহেবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষষ্ট হতে থাকল। তিনি তাকিয়ে আছেন রফিকের দিকে। রফিক বলল- আপনি যদি একে অপরাধী মনে করেন, তাহলে মেরে ফেলেন। লজ্জা দেবার দরকার কী?
:তুমি একে অপরাধী মনে কর না?
:না। আমার মনে হয় সে কিছু জানে না।
:সে এই গ্রামে থাকে, আর এত বড় একটা ব্যাপার জানবে না?
:জানলে বলতো। কিছু জানে না, তাই বলছে না।
:বলবে সে ঠিকই। ইট বেঁধে তাকে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাও- দেখবে তার মুখে কথা ফুটেছে। তখন সে প্রচুর কথা বলবে।
রফিক ঠাণ্ডা স্বরে বলল- স্যার, ওকে এ-রকম লজ্জা দেয়াটা ঠিক না।
:কেন ঠিক না?
:আপনি শুধু ওকে লজ্জা দিচ্ছেন না, আপনি আমাকেও লজ্জা দিচ্ছেন। আমিও ওর মত বাঙালি।..."
গুলি করে মেরে ফেলা হয় হিন্দু নীলু সেনকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কৈবর্তপাড়া। নগ্ন আজিজ মাস্টারকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জয়নাল মিয়ার মুখোমুখি করা হয়। আজিজ মাস্টার জয়নাল মিয়ার বাড়িতে থাকে। জয়নালের কিশোরী মেয়েকে মনে মনে ভালোবাসে, তাকে নিয়ে কবিতা লেখে। পাক মেজর জয়নালকে জানায়, এই নেংটো মাস্টার তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। জয়নাল শুনে হতভম্ব। নিপীড়নের এক পর্যায়ে আজিজ মাস্টার দৃঢ় হয়ে ওঠে। মেজরকে বলে, আমি মরার জন্য প্রস্তুত। আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান। রাজাকাররা তাকে নিয়ে যায় বিলের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলঘরের পেছনে কয়েকটি গুলির শব্দ হলো। জয়নাল মিয়া থরথর করে কাঁপতে লাগল।
উপন্যাসের শেষাংশে সেই রফিককেও বিলে নামানো হয়। চায়নিজ রাইফেল হাতে দুই জওয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। বিলে রফিকের হাতে ঠেকে গুলিতে নিহত কৈবর্তপাড়ার বিরুর লাশ। বুক-পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা রফিককে মেজর এজাজ বলে, রফিক তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও?
"রফিক শান্ত স্বরে বলল- চাই মেজর সাহেব। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আপনি নিজেও চান। চান না?
মেজর সাহেব চুপ করে রইলেন। রফিক তীক্ষষ্ট স্বরে বলল- মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এদেশ থেকে।
মেজর এজাজ আহমেদ সিগারেট ধরালেন, কৈবর্তপাড়ার আগুনের দিকে তাকালেন। পশতু ভাষায় সঙ্গে জোয়ান দুটিকে কী যেন বললেন। গুলির নির্দেশ হয়তো। রফিক বুঝতে পারল না। সে পশতু জানে না।
হ্যাঁ, গুলির নির্দেশই হবে। সৈন্য দুটি বন্দুক তুলছে। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।
বুক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে লালচে আগুনের আঁচে যে রফিক দাঁড়িয়ে আছে, মেজর এজাজ আহমেদ তাকে চিনতে পারলেন না। এ অন্য রফিক। মেজর এজাজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।"
একাত্তরের পটভূমিতে সুন্দর একটি উপন্যাস আমরা পেলাম হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি নিজেও হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তার বেঁচে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের কথাশিল্প অনেক অনেক ঋদ্ধ হয়েছে। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো সম্পর্কে তার নিজের ভাষ্য এ রকম :'লেখা হলো ১৯৭১, আগুনের পরশমণি, সূর্যের দিন। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা এইসব লেখায় ধরা পড়েছে- এমন দাবি আমার নেই। দাবি এইটুকু- আমি গভীর ভালোবাসায় সেই সময়ের কিছু ছবি ধরতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি, তার বিচারের ভার আজকের এবং আগামী দিনের পাঠকদের উপর।'
সূত্র: সমকাল
এমএ/ ১০:৪৪/ ১৮ জুলাই